প্রতিটি নারীর জীবনে মাসিক একটি অতি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার হলেও বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টি এখনো যেন অত্যন্ত গোপনীয় ও লজ্জাজনক ঘটনা। দেশে বর্তমান ৫ কোটি ৪০ লাখ কিশোরী ও নারীর মাসিকের অভিজ্ঞতা হয়েছে (সুলতানা, আইসিডিডিআর’বি,২০২০)। সম্প্রতি প্রকাশিত ‘বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮’ এর প্রতিবেদনে জানা যায়, এদেশের শতকরা ৫৫ ভাগ কিশোরী আর ৬৮ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক নারী তাদের মাসিককালীন কাপড় (নতুন ও পুরনো মিলিয়ে) ব্যবহার করেন। মাসিক ব্যবস্থাপনায় কাপড় ব্যবহার ততক্ষণ পর্যন্ত নিরাপদ যতক্ষণ পর্যন্ত তা সাবান পানিতে ধুয়ে রোদে শুকানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মাত্র ১২ ভাগ কিশোরী ও ১৮ ভাগ নারী এমন যথাযথ ব্যবস্থাপনায় মাসিককালীন ব্যবহৃত কাপড় পুনরায় ব্যবহার করেন। বাকিরা দীর্ঘসময় অস্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনায় কাপড় ব্যবহার করে নানা জটিল রোগের শিকার হন। তাই বিশেষজ্ঞরা মাসিককালীন স্বাস্থ্যকর ব্যবস্থাপনা হিসেবে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে থাকেন (বিবিসি বাংলা,২০১৯)।
সে হিসাবে বর্তমানে গড়ে শতকরা ৩৬ ভাগ নারী (কিশোরী ও প্রাপ্তবয়স্ক) মাসিকের সময় ডিসপোজেবল প্যাড (যা একবার ব্যবহারযোগ্য) ব্যবহার করেন (হাইজিন সার্ভে ২০১৮), যা আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। নিঃসন্দেহে, এটি একটি ইতিবাচক পরিবর্তন। কিন্তু ব্যবহৃত এই স্যানিটারি প্যাডের নিষ্পত্তির সঠিক ব্যবস্থাপনা এখনো অনুপস্থিত। এর ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় হয়তো খুব শিগগিরই পরিমাণ ও উপাদানগত দিক থেকে এ নিয়ে একটা বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি হতে যাচ্ছে, যা পরিবেশের ক্ষতি বাড়িয়ে তুলবে।
যদিও সরাসরি কোনো পরিসংখ্যান নেই তথাপি সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি থেকে প্রাক্কলন করা যায় যে, ৫ কোটি ৪০ লাখ নারীর ৩৬ ভাগ অর্থাৎ ১ কোটি ৯৪ লাখ ৪০ হাজার নারী গড়ে ৫ দিনে (দ্য সোসাইটি অব অবস্টেট্রিসিয়ান্স অ্যান্ড গাইনোকোলোজিস্টস অব কানাডা) যদি সর্বোচ্চ প্রতি ৮ ঘণ্টা পর পর (ইউনিসেফ, ২০১৯ পরামর্শ অনুযায়ী) ডিসপোজেবল প্যাড ব্যবহার করেন তাহলে রক্তের প্রবাহের মাত্রা আর শোষণক্ষমতা অনুযায়ী একজন মেয়ে প্রতি মাসিকচক্রে প্রথম তিন দিনে ৯টি আর পরবর্তী দুই দিনে প্রতি ১২ ঘণ্টার ব্যবধানে ৪টি মিলিয়ে সর্বনিম্নে মোট ১৩টি ডিসপোজেবল প্যাড ব্যবহার করেন। ভারতীয় কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গাইড (২০১৬) অনুযায়ী একটি মাসিক চক্রে একজন নারী ৮টি প্যাড ব্যবহার করেন। অন্যদিকে, ভস্ট্রাল (২০০৮) তার গবেষণায় বলেছেন, একটি মাসিক চক্রে একজন নারীর ১১টি প্যাড বা ন্যাপকিন লাগে। আমাদের দৈহিক গড়ন ও বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে ভারতীয়দের মিল রয়েছে সে হিসাবে আমরা যদি ১৩টি প্যাডের পরিবর্তে ভারতের হিসাবের কাছাকাছি ১০টি প্যাডও প্রাক্কলন করি তাহলে মাসে ন্যূনতম ১৯কোটি ৪৪ লাখ ডিসপোজেবল প্যাড ব্যবহৃত হয়। বাংলাদেশে স্যানিটারি প্যাডের বড় অংশটি আমদানি হয় ভারত, চীন এবং থাইল্যান্ড থেকে। এছাড়া স্থানীয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানও তৈরি করে প্যাড (সাইয়েদা আক্তার, বিবিসি বাংলা, ২০১৯)। এসব প্যাড হয় দুই রকমের। যথা কটন প্যাড এবং জেল প্যাড। এসব প্যাডের গায়ে পলিথিন শিল্ড বা প্লাস্টিক ব্যবহার করা হয়। প্যাডের চারপাশে ও নিচে থাকা প্লাস্টিকের কারণে লিকেজ হয় না ফলে রক্ত বাইরে বের হতে পারে না। বাংলাদেশে প্রচলিত ন্যাপকিনের মধ্যে বাজার দখল করে আছে সেনোরা শতকরা ৬৫, জয়া ১৪, হুইসপার ৮.০৫ এবং ফ্রিডম ৭ ভাগ (দ্য ডেইলি স্টার, ২০২০)। তাই আমরা আমাদের গবেষণার জন্য উল্লেখযোগ্য কয়েকটি ন্যাপকিনের কটন ও জেল প্যাড নমুনা হিসেবে বেছে নিয়েছিলাম গড়ে একটি ন্যাপকিনের প্লাস্টিকের ওজন পরিমাপের জন্য। পোল্যান্ডের ‘অ্যানালিটিক্যাল ব্যালান্স মডেল এএস২২০.আর২’ পরিমাপক যন্ত্রের (এমন একটি ল্যাব যন্ত্র যা সঠিকভাবে ২২০ গ্রাম পর্যন্ত ভর পরিমাপ করতে পারে এবং এর পাঠ্যতা রয়েছে ০.০০০১ গ্রাম) সাহায্যে আমরা বের করি গড়ে একটি প্যাডে ৩.২৮৫৯ গ্রাম প্লাস্টিক থাকে যা ব্যবহারের পর অপচনশীল বর্জ্যে পরিণত হয়। অন্যদিকে একজন নারী মাসে ১০টি প্যাড আর ১টি ন্যাপকিনের প্যাকেট ফেলছেন। গড়ে একটি স্যানিটারি ন্যাপকিনের খালি প্লাস্টিকের প্যাকেটের ওজন থাকে ৫.৮৮৯ গ্রাম। ফলে মাসে একজন নারী এক্ষেত্রে মোট ৩৮.৭৪৮ গ্রাম বর্জ্য তৈরি করছেন। সেই হিসাবে সমগ্র বাংলাদেশে স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারকারী ঋতুবতী নারীদের ব্যবহৃত স্যানিটারি প্যাডের প্লাস্টিক এবং প্যাকেটের কারণে প্রতি বছর কম করে হলেও প্রায় ৯০৩৯ মেট্রিক টন বর্জ্য উৎপন্ন হয় যা ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬২৩ মণের সমান।
বাজারে প্রচলিত বিভিন্ন ব্র্যান্ডের ডিসপোজেবল প্যাডের প্যাকেটের গায়ে ‘বিএসটিআই’ বা ‘এসএমসি’র লোগো ব্যবহৃত হলেও সব প্যাকেটের গায়ে সেটা তৈরির উপাদান উল্লেখ থাকে না। কিন্তু নি®পত্তির নির্দেশনায় বলা আছে ব্যবহৃত প্যাড কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে ডাস্টবিনে ফেলতে এবং ব্লকেজ প্রতিরোধে কমোডে নি®পত্তি না করতে। এ কথা থেকে এটা পষ্ট যে, এ সমস্ত কমার্শিয়াল স্যানিটারি ডিসপোজেবল প্যাডগুলো পানিতে দ্রবীভূত হয় না। একই সঙ্গে প্লাস্টিকের স্তর থাকে বলে তা মাটিতেও পচনযোগ্য নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে স্যানিটারি প্যাড কোনো কোনো ক্ষেত্রে ৯০ শতাংশও প্লাস্টিকের তৈরি হতে পারে (সাইয়েদা আক্তার, বিবিসি বাংলা, ২০১৯)। অধিক শোষণ ক্ষমতাযুক্ত এসব প্যাডের শোষণ ক্ষমতা বাড়াতে যেসব রাসায়নিক পদার্থ এবং প্লাস্টিকের স্তর ব্যবহৃত হয় তা কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত এবং পরিবেশবান্ধব তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।
বাংলদেশে এখনো পর্যন্ত কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা নেই।
তথাপি ২০১৯ সালে প্রথম আলো আয়োজিত ‘টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা জরুরি’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় উঠে আসা দুই ধরনের বর্জ্যরে (কঠিন ও তরল) মধ্যে ব্যবহৃত ডিসপোজেবল স্যানিটারি ন্যাপকিন স্বাভাবিকভাবেই একটি কঠিন বা সলিড বর্জ্য (প্রথম আলো ২০১৯, সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুলস, ভারত, ২০১৬)। বিএসটিআই-এর অন্তর্ভুক্ত টেক্সটাইল এই পণ্যটির প্লাস্টিক উপাদানটি অপচনশীল। বিশেষজ্ঞদের মতে একটি স্যানিটারি প্যাডের মাটিতে পুরোপুরি মিশে যেতে সময় লাগে প্রায় ৫০০ বছর (অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়, ২০১৮)। কারও কারও মতে তা হতে লাগবে ৮০০-৯০০ বছর (সলিড ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট রুলস, ভারত, ২০১৬)।
শহরাঞ্চলে ব্যবহৃত এ প্যাডগুলো ফেলে দেওয়া হয় গৃহস্থালির ময়লার সঙ্গে, ডাস্টবিনে কিংবা খোলা জায়গায় (শাশ্বতী বিপ্লব, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর, ২০২০)। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন সার্ভে ২০১৮ রিপোর্টে প্রকাশ পেয়েছে গৃহস্থালির ময়লা পিট বা ড্রামে ফেলে শতকরা ৩৯ ভাগ পরিবার। এছাড়া জলজ উৎসে ফেলে ১৬ ভাগ। বাকিরা রাস্তার ধারে, ড্রেনে কিংবা বন-জঙ্গলে ফেলেন। পচনশীল নয় বলে এই স্যানিটারি প্যাডের অজৈব বর্জ্য কোথাও না কোথাও গিয়ে স্তূপ হতে থাকে।
এখনই যদি গুরুত্ব দেওয়া না হয় তাহলে অতি সন্নিকটে মাসিককালীন বর্জ্য একটি সামাজিক এবং পরিবেশগত সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। আমাদের বাজারে প্রচলিত নন-কম্পোস্টেবল স্যানিটারি ন্যাপকিনের পরিবর্তে কম্পোস্টেবল স্যানিটারি ন্যাপকিনের অথবা পুনরায় ব্যবহারযোগ্য পণ্যের ব্যাপারে আগ্রহী হতে হবে। প্রয়োজনে এ বিষয়টি কীভাবে আমাদের পরিবেশ ও অর্থনীতিবান্ধব হয় তা নিয়ে গবেষণা করতে হবে। কেননা নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ পরিবেশবান্ধব স্যানিটারি প্যাডের ব্যবহারকে উৎসাহিত করা যতটা জরুরি ঠিক ততটাই জরুরি এসব প্যাডের সুষ্ঠু নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা। সেটা করা না হলে এই বিশেষ পাঁচদিনের বর্জ্যরে বোঝা এই পৃথিবীকে বয়ে বেড়াতে হবে ৫০০ থেকে ৯০০ বছর।
লেখকদ্বয় : যথাক্রমে সহকারী অধ্যাপক ও শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান, বিভাগ হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর
1 comment
A new dimension in waste management! It’s high time to bri6up this kinda idea.