এই ব্লগে আমি আলোচনা করব বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ নিয়ে।যাকে নব্য সিল্ক রোড ও বলা হচ্ছে । আজকে আমরা এই রোড এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ইম্পেক্ট গুলা বুঝার চেস্টা করব। শুরুতেই জেনে নিব সিল্ক রোড
সিল্ক রোড কি ?
গত দুই হাজার বছর আগে পৃথিবী বাহ্যিকগুলো ছিল রোড কেন্দ্রিক অর্থাৎ তখন বর্তমানে সময় বা তার আগে যেভাবে জাহাজে করে ব্যবসা বাণিজ্য হয় তেমন ছিল না আমরা যেমন দেখেছি ভারতবর্ষে ডাচ, পর্তুগিজ, স্প্যানিশ, ব্রিটিশরা জাহাজে করে এসে আমাদের দেশে ব্যবসা করেছিল । কিন্তু ২০০০ বছরের জাহাজ যখন আবিষ্কৃত ছিল না তখন ইউরোপ,এশিয়া,আফ্রিকার মানুষজন কাফেলা করে বাণিজ্য করতে যেত । তৎকালীন সময়ে চীনে উৎপাদিত হত সবচেয়ে বিলাসবহুল দ্রব্য সিল্ক কাপড় ।এই কাপড় পুরো ইউরোপ, আফ্রিকা এশিয়া,মানুষের কাছে ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয় দ্রব্য ।
ঠিক চীনে সেই সময় হান রাজবংশ প্রতিষ্ঠিত ছিল ।এই রাজবংশ চীনে প্রায় ৪০০ বছর রাজত্ব করেছিল । চীনের অন্যতম স্বর্ণযুগ ছিল এই এই হান সাম্রাজ্যের সময়কালে । হান রাজবংশ এই সিল্ক ব্যাবসাকে কেন্দ্র করে একটা নতুন নেটওয়ার্ক তৈরি করে যা মেসোপটেমিয়া এবং ইউরোশিয়া সভ্যতা পর্যন্ত । এই হান সাম্রাজ্যের স্বর্ণযুগের অন্যতম কারণ ছিল তৎকালীন অন্যতম বিলাসবহুল সিল্ক কাপড়ের কারণে । এই কাপড় পুরো ইউরোপ এবং মধ্য এশিয়ায় খুব জনপ্রিয় ছিল । ফলে ইউরোপ এবং এশিয়া কারণে ব্যবসায়ীরা চীনে যেত সিল্ক কিনতে বিনিময়ে তারা দিত ঘোড়া, স্বর্ণ, আইভরি,পশম,কাচের জিনিসপত্র । সিল্করোড— নাম করা হয় এই সিল্ক এর কারণেই । কিন্তু সিল্ক রোডের ইতিহাস হান সাম্রাজ্যের ও অনেক আগে শুরু হয়। পারস্যের( বর্তমান ইরান) রয়্যাল রোড ই মূলত সিল্ক রোডের প্রধান পয়েন্ট । সিল্ক রোড যাত্রা শুরুর ও ৩০০ বছর পূর্বে দ্য রয়্যাল রোড যা ইরান থেকে শুরু হয়ে তুরস্ক পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, তার যাত্রা শুরু করে। তৎকালীন পারস্যের শাসনকর্তা প্রথম দারিয়াস কর্তৃক এই রাস্তাটি নির্মিত হয়। আশেপাশের বিভিন্ন ছোট বাণিজ্য পথ এগুলোকেও যুক্ত করে, যেমন মেসোপটেমিয়া থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং মিশর হয়ে উত্তর আফ্রিকা ইত্যাদি। পরবর্তীতে মেসিডোনিয়া রাজা অ্যালেকজান্ডার দ্য গ্রেট রয়াল রোড হয়ে পারস্য পর্যন্ত তার সাম্রাজ্য বিস্তার করে। এরপর এই রয়্যাল রোডের ই অনেকটা অংশ সিল্ক রোডের অন্তর্ভুক্ত হয়।
তাহলে বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ কি ?
বেল্ট রোড সিল্ক রোড থেকে ইন্সপায়ারড এমন একটি প্রজেক্ট যা কিনা চীনের সাথে সাউথ এশিয়া ,, সাউথ-ইস্ট এশিয়া, মধ্য এশিয়া, রাশিয়া ইউরোপ ,সাউথ প্যাসিফিক আফ্রিকাকে কানেক্ট করবে করবে । তবে এই শতাব্দীতে এইটা একটু ভিন্নভাবে কাজ করবে । পুর্বে সিল্করোড ছিল শুধু মাত্র বাই রোড কিন্তু এই নতুন সিল্ক রোড মেরিটাইম সহ আরো অনেক ভাবে যোগযোগ ব্যাবস্থা থাকবে ।
বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ সংক্ষেপে BRI নিয়ে চায়নার কি প্ল্যান?
চীনের সবচেয়ে উচ্চবিলাশ প্রজেক্ট হচ্ছে ওয়ান রোড কিংবা বেল্ট রোড । প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং কাজাখাস্তান এবং ইন্দ্রোনিশিয়া ভ্রমণ করার করার সময় ২০১৩ সালের সেপ্টেম্বরে এই প্রজেক্টের কথা প্রথম প্রকাশ করেন । শিং জিংপিং এর ভিশন হচ্ছে সড়ক এবং নৌ পথে চীনকে সমগ্র এশিয়া, ইউরোপ এবং আফ্রিকার সাথে সংযুক্ত করা। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে চীনের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রভাব বিশ্বে উল্লেখযোগ্যভাবে সম্প্রসারিত হবে। এই প্রকল্পে যে-সব দেশ চুক্তিবদ্ধ থাকবে সেসব দেশগুলো একে অপরের সাথে বন্দর, সড়ক, রেলপথ এবং বিমানবন্দরের পাশাপাশি বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে কানেক্ট হবে । এর ফলে দেশগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আর্থসামাজিক উন্নয়ন সাধিত হবে ।
এখন পর্যন্ত বিআরআই এর সাইট এর তথ্য মতে তাদের অংশীদার ১৪৯টি দেশ অংশীদার হয়েছে । তার মধ্যে আফ্রিকার দেশ ৫২ টি , এশিয়ার ৩৮ টি , ইউরোপ এর ২৭ টি , নর্থ আমেরিকার ১২ টি , ওশেনিয়ার ১১ টি , আর সাউথ আমেরিকার ৯ টি দেশ । তথ্য সুত্র এই লিঙ্ক । চীন অলরেডি এই প্রজেক্টের পিছনে ৪ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করার কথা জানিয়েছে সব ধরনের অবকাঠামো নির্মানে ।
এই প্রজেক্ট থেকে বাংলাদেশ এর মত দেশ গুলো কি ধরনের লাভ পেতে পারে ?
প্রথমত এই সব দেশ গুলোতে প্রচুর চীনা বিনিয়োগ বাড়বে এবং চীনের বাজার আরো বেশি ডিসেন্ট্রালাইজড হবে । আপনি যদি বর্তমানে চীনের প্রডাক্ট গুলো লক্ষ করেন তাহলে দেখবেন চীনের প্রডাক্ট গুলো এখন হাই-টেক যুক্ত অর্থ্যাৎ তারা আগের মত কপি ক্যাট গিমিক প্রোডাক্ট গুলো বানায় নাহ । অতিতে আমরা দেখেছি চীনের প্রোডাক্ট ডাম্পিং এর মত বিষয় গুলা , যা ফলে বাংলাদেশ এর মত দেশ গুলার লোকাল বাজারে তৈরী করা প্রোডাক্ট গুলোর বাজার নস্ট হয়ে যেত । যা বহু অংশে কমে আসবে যদি আমি বিষয় গুলা ডিরেক্ট পয়েন্ট আউট করি –
- বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বাড়বে।
- চীন কে একটি ‘অর্থনৈতিক অঞ্চল’ দেয়া হবে যেখানে চীনা ব্যাবসায়ীরা বিনিয়োগ করবে।
- চীন বর্তমানে অনেক পন্য উৎপাদন করছে না, তারা এখন হেভি এবং আধুনিক পন্য উৎপাদনে আগ্রহী, এছাড়া সেখানে শ্রমিকের বেতন বেড়ে যাচ্ছে ফলে তারা ফ্যাক্টরি বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামে স্থানান্তর করবে, যার ফলে বাংলাদেশের বিনিয়োগ বাড়বে।
- বাংলাদেশে থেকে চীনে আমদানি রপ্তানি সহজ হবে, এবং রপ্তানি বাড়বে।
- বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বর্তমানে চীনের বিনিয়োগ চলছে। পদ্মা রেল সংযোগ, মাতারবাড়ি বিদ্যুত হাব, মহেশখালি বিদ্যুত হাবে বিনিয়োগ করেছে।
- চীন বাংলাদেশের সোনাদিয়াতে একটি গভীর সুমদ্র বন্দর করার চুক্তি করেছে , যদিও সমুদ্র বন্দরের কাজ শুরুর আগেই চুক্তি স্থগিত আছে।
- এই চুক্তির ফলে বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ বেড়েছে। গত ২০১৩-২০১৯ এর বাংলাদেশে কোন দেশের একক বিনিয়োগে চীন নাম্বার ওয়ানে অবস্থান করছে। – বাংলাদেশে চীনা বিনিয়োগের ঢেউ
এই প্রজেক্ট হতে চীনের আসল লক্ষ্য কি ?
আপনি চীনের লক্ষ্য বুঝতে হলে আগে চীনের বিজন্যাস স্ট্রেটেজী বুঝতে হবে । চীন যখন WTO অর্গানাইজেশন এ জয়েন করে তখন চীন প্রমিস করে তাদের মার্কেটটা অনেক সহজলভ্য করবে আগে চেয়ে । যেমন আগে চাইলে কোন বিদেশী কোম্পানী তাদের মার্কেটে এন্টার করতে পারত না। কিন্তু চীন এই প্রমিশ করে বিশ্ব বাজারে প্রবেশ করে তাদের সব গিমিক , কপি ক্যাট, সস্তা প্রডাক্ট ।কিন্তু তারা ওয়ার্ল্ড ট্রেন্ড অর্গানাইজেশনকে তাদের প্রফিট এর জন্য ইউজ করে । তারা বিশ্ব বাজারে তাদের প্রডাক্ট ছেড়ে দিয়েছে ঠিকই কিন্তু অন্য দেশের প্রোডাক্ট তাদের দেশে কোন সুবিধা করে উঠতে পারে নি । যার কারনে আজকে চীনের গুগল , ইউটিউব সব অনেক প্রোডক্ট ব্যান । এমনকি জনপ্রিয় রাইড সার্ভিস উবার এত বড় মার্কেটে কোন লাভ ছাড়াই মার্কেট থেকে ব্যাগ ঘুছিয়ে চলে আসতে হয়েছে ।
চীনের সবসময় লক্ষ্য ছিল তাদের কম্পিটিটর আমেরিকাকে তারা অর্থনৈতিক ভাবে ছাড়িয়ে যাবে এবং তারা ছাড়িয়ে যেতে সামর্থ্য হয়েছে প্রায় বলা যায় । এখন তাদের লক্ষ্য রাজনৈতিক ভাবে বিশ্বে প্রভাব সৃষ্টি করা । এর জন্য আমাদের মার্শাল প্ল্যান সম্পর্কে জানতে হবে । ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবির সব দেশ এর অর্থনীতির ভঙ্গুর অবস্থা তখন চীনের অর্থনীতি আঙ্গুল ফুলে কলা গাছের ন্যায় কেননা ২য় বিশ্ব যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র সরবাহকারী দেশ আমেরিকাই ছিল সুতরাং সকল দেশ গুলোর অর্থ শেষ হয়ে গেলে তারা গোল্ড বার এর বিনিময়ে অস্ত্র কিনতে শুরু করে । ফলে পৃথীবির ৭০% গোল্ড এর রিজার্ভ চলে যায় আমেরিকার কাছে । ২য় বিশ্ব যুদ্ধের ফলে ব্রিটেন আর ফ্রান্সের কোলোনাইজেশন টোটালি অফ হয়ে যাওয়ায় তাদের অর্থনীতি প্রায় জীর্ণ শীর্ন অবস্থা এমন অবস্থায় আমেরিকা একটা প্ল্যান হাতে নেয় এই প্ল্যানকে বলা হয় মার্শাল প্ল্যান । এই মার্শাল প্ল্যান এর ধারনা দেন আমেরিকার সেক্রেটারী অফ স্টেইট George C. Marshall । এই প্ল্যানকে ইউরোপ রিকোভারী প্ল্যান ও বলা হয় । এই প্ল্যান এর আওতায় ইউরোপ এর প্রভাবশালী ১৬ টি দেশকে ১৬ বিলিয়ন ডলার এর কাছাকাছি আর্থিক সহযোগিতা এবং ইনভেস্টমেন্ট করা হয় যাতে তারা আবার অর্থনৈতিক ভাবে ঘুরে দাঁড়াতে পারে । এর ফলে আমেরিকা ইউরোপে তাদের ডমিনেন্স ক্রিয়েট করা শুরু করে । শুরুটা ইউরোপ দিয়ে হলেও সেটা আস্তে আস্তে পৃথীবিব্যাপি ছড়িয়ে পড়ে। ঠিক একই কাজ চীন করতে চাচ্ছে তবে ভিন্নভাবে তারা চাচ্ছে তারা তাদের নতুন রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সাম্রাজ্য কায়েম করতে আমেরিকাকে হটিয়ে । তাই এত এত ডলার এর অনুদান দিচ্ছে আফ্রিকার মত দেশ গুলো কে ।
ধন্যবাদ যারা আমার পুরো লিখাটি পড়েছেন । যদি আমার লিখা ভাল লাগে তাহলে অবশ্যই শেয়ার করবেন । আর কোন ফিডব্যাক থাকলে কমেন্টে জানতে পারেন ।
তথ্যসুত্রঃ
Marshall Plan | Summary & Significance | Britannica
The Marshall Plan: Definition, Date & Cold War – HISTORY
China: number of BRI partner countries by region 2022 | Statista
Belt and Road Initiative: Perspective from Bangladesh | The Daily Star