কবে বাকশাল গঠন করা হয়েছেে?

বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের যে পদক্ষেপ নিয়ে এখনও সবচেয়ে বেশি বিতর্ক হয়, সেটি হচ্ছে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা। এই শাসন ব্যবস্থা বাকশাল নামে পরিচিত। দেশটির সংবিধানে চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি।

একটা কৃষিনির্ভর আধা-সামন্ত সামাজিক অবস্থা থেকে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও শোষণমুক্ত বাংলাদেশ গঠনের সংগ্রামকে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ বলে অভিহিত করতেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। রাজনৈতিক মুক্তি অর্জনের সংগ্রামে সফল হয়ে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে পুরো রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে গিয়ে জাতির জনক গোড়াপত্তন করেছিলেন ‘বাকশাল’ এর। ‘বাকশাল’ মানে কী? আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগের নামে ‘রাজনীতি’ করে সমাজে বেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন এমন অনেকের সাথে কথা বলে দেখেছি ‘বাকশাল’ মানে বুঝেনা। আর বিএনপি-জামাত ও তাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিবৃত্তিক দোসররা ‘বাকশাল’ প্রসঙ্গে যুগ যুগ ধরে এমনই নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ শক্তিও বাকশাল নিয়ে কথা বলতে আজ আর স্বস্তিবোধ করেন না। ফলে বাকশাল সম্পর্কে জেনে-না জেনে একপ্রকার নেতিবাচক ধারণা নিয়ে বড় হয় এদেশের নতুন প্রজন্ম। অথচ বাকশাল হতে পারত উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার শক্তিশালী প্লাটফর্ম।

বাকশাল কোনো একনায়কতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারণা ছিলনা। স্বাধীনতার নামে স্বেচ্ছাচারীদের নিয়ে নিয়ন্ত্রণে এনে সরকারি-বেসরকারি উৎপাদন ব্যবস্থায় সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতি বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধু ‘বাংলাদেশ কৃষক, শ্রমিক, আওয়ামীলীগ (বাকশাল)। ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তৎকালীন স্পিকার আব্দুল মালেক উকিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদের সপ্তম অধিবেশনের দ্বিতীয় বৈঠকে ভাষণে তিনি বলেন, ‘আপনার মনে আছে যে, সংবিধান যখন পাস করা হয়, আমি বলেছিলাম যে, এই দেশের মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শোষণহীন সমাজ-ব্যবস্থার জন্য যদি দরকার হয়, এই সংবিধানের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা হবে’।

জাসদের গণবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতন-হত্যা, আওয়ামীলীগের এক শ্রেণির নেতা–কর্মী ও আমলাদের দুর্নীতি, সরকারি নানা তহবিলের তসরুফ, পাকিস্তানপন্থী সাংবাদিক ও অন্যান্য বুদ্ধিজীবী সমাজের যোগসাজশে সাংবাদিকতার নামে সরকার-বিরোধী সিস্টেম্যাটিক অপপ্রচার ইত্যাদি নানা অরাজকতার অবসান ঘটিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্র ও সমাজের সর্বস্তরে শৃঙ্খলা এনে সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠনের নিমিত্তে বঙ্গবন্ধু বাকশাল ব্যবস্থার সূচনা করেন। সংসদের ভাষণে তিনি বাকশাল সম্পর্কে আরও বলেছিলেন, ‘ অ্যামেন্ডেড কনস্টিটিউশনে যে নতুন সিস্টেমে আমরা যাচ্ছি, তাও গণতন্ত্র। শোষিতের গণতন্ত্র। এখানে জনগণের ভোটাধিকার থাকবে। এখানে আমরা শোষিতের গণতন্ত্র রাখতে চাই’।

সংবিধানের সংশোধন সম্পর্কে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘ সংবিধানের এই সংশোধন কম দুঃখে করি নাই, স্পীকার সাহেব। যারা জীবনভর সংগ্রাম করেছে- এ কথা যেন কেউ মনে না করে যে, জনগণের ভোটাধিকার কেড়ে নিয়ে গেছে। জনগণ যা চেয়েছে, এখানে সেই সিস্টেম করা হয়েছে। তাতে পার্লামেন্টের মেম্বারগণ জনগণের ভোটের দ্বারা ভোটে নির্বাচিত হবেন। যিনি প্রেসিডেন্ট হবেন, তাঁকেও জনগণের ভোটে নির্বাচিত হতে হবে। জনগণের ভোটাধিকার আছে’।…আজকে আমূল পরিবর্তন করেছি সংবিধানকে। কারণ একটা সুষ্ঠু শাসন-ব্যবস্থা এ এদেশে কায়েম করতে হবে, যেখানে মানুষ শান্তিতে ঘুমাতে পারে, যেখানে মানুষ অত্যাচার, অবিচার হতে বাঁচতে পারে’।

গরীব-দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর নিমিত্তে নিমিত্তে প্রণীত বাকশালকে জাতির পিতা ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’ বলে বর্ণনা করেছিলেন। জাসদের গণবাহিনী ও অন্যান্য রাষ্ট্রবিরোধী অপশক্তিগুলোকে নিয়ন্ত্রণে এনে তাদের অত্যাচার, নির্যাতন বন্ধ করে সারাদেশে শৃঙ্খলা আনতে চেয়েছিলেন তিনি। আওয়ামীলীগ ছাড়া যেসব রাজনৈতিক দল জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে, তাদেরকেও নতুন সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আহবান ছিল জাতির পিতার। সংসদে সেদিন তিনি বলেছিলেন, ‘ যারা দেশকে ভালবাসেন, চারটি প্রিন্সিপল-কে ভালবাসেন-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষতা-এই চারটিকে, তাঁরা আসুন, কাজ করুন। দরজা খোলা আছে। সকলকেই আহ্বান জানাচ্ছি। যারা এই মতে বিশ্বাস করেন। যারা এই মতে বিশ্বাস করেন, তাঁদের প্রত্যেকেই আসুন, কাজ করুন, দেশকে রক্ষা করেন। দেশকে বাঁচান, মানুষকে বাঁচান, মানুষের দুঃখ দূর করুন। আর দুর্নীতিবাজ, ঘুষখোর, চোরাকারবারিদের উৎখাত করুন’।

১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাকশাল কর্তৃক আয়োজিত জনসভায় ভাষণ প্রদান করেন জাতির পিতা। যুদ্ধ-পরবর্তী বাংলাদেশ এর বিধ্বস্ত অর্থনীতি, পাকিস্তানের কাছ থেকে পাওনা না পাওয়া ইত্যাদি কথা বলে বাকশালের রূপরেখা নিয়ে পুনরায় কথা বলেন জাতির পিতা শেখ মুজিব। তিনি বলেন, ‘ প্রেসিডেন্সিয়াল ফরম অব গভর্নমেন্ট করেছি। জনগণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে। পার্লামেন্ট থাকবে। পার্লামেন্টের নির্বাচনে একজন, দুইজন, তিনজনকে নমিনেশন দেওয়া হবে। জনগণ বাছবে, কে ভাল, কে মন্দ। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র, আমরা চাইনা শোষকের গণতন্ত্র’।

বাকশালের ফরমেটে সরকার ব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, ‘২৫/৩০ বৎসরে বাংলায় কোন জমি থাকবেনা হাল চাষ করার জন্য। বাংলার মানুষ বাংলার মানুষের মাংস খাবে। সেই জন্য আজকে আমাদের পপুলেশন কন্ট্রোল, ফ্যামিলি প্ল্যানিং করতে হবে। এটা হল তিন নম্বরের কাজ। এক নম্বর কাজ হল-দুর্নীতিবাজ খতম করা। দুই নম্বর হল-কলে-কারখানায়, ক্ষেতে-খামারে প্রোডাকশন বাড়ানো। তিন নম্বর হল-পপুলেশন প্ল্যানিং। চার নম্বর হল, জাতীয় ঐক্য’।

নতুন সিস্টেমের গ্রাম বাংলার অবস্থা কী দাঁড়াবে সে বিষয়ে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘ যে নতুন সিস্টেমে যেতে চাচ্ছি আমি, তাতে গ্রামে গ্রামে বহুমুখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভুল করবেন না। আমি আপনাদের জমি নেবনা। ভয় পাবেন না যে, জমি নিয়ে যাব। তা নয়, পাঁচ বৎসরের প্ল্যানে বাংলাদেশ ৬৫ হাজার গ্রামে একটি কো-অপারেটিভ হবে। প্রত্যেকটি গ্রামে এই কো-অপারেটিভ। এর জমি মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার ফসলের অংশ সবাই পাবে। প্রত্যেকটি বেকার, প্রত্যেকটি মানুষ,- যে মানুষ কাজ করতে পারে, তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে। এগুলি বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। পয়সা যাবে তাদের কাছে, ওয়ার্কস প্রোগ্রাম যাবে তাদের কাছে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিলে যারা টাউট আছেন, তাদের বিদায় দেওয়া হবে। তা না হলে দেশকে বাঁচান যাবেনা। এই জন্যই ভিলেজ কো-অপারেটিভ হবে’।

বাকশাল কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বঙ্গভবনে। সেখানে বাকশালের নেতৃবৃন্দকে উদ্দেশ্য করা রাখা ভাষণে বঙ্গবন্ধু দুঃখ করে বলেছিলেন, ‘ আমাদের দেশে বহু দিনের একটা মেন্টালিটি দেখেছি। কিছু একটা নতুন জিনিস দেখলে আমাদের একটা বাধা আসে। বিপ্লব কাকে বলা হয়। পুরনো রীতি, যেটা দেশের মঙ্গল করেনা, সেই রীতি বদলানোর মত সৎ সাহস থাকা প্রয়োজন। পুরনো আইন, যে আইন দেশের মঙ্গল করেনা, সেই আইনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করবার অধিকার বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে। যে সিস্টেম আজ আমরা দেখি, সেই সিস্টেম ব্রিটিশ কলোনিয়াম সিস্টেম। ব্রিটিশ সিস্টেম করে গিয়েছিল বা যেটা আমাদের দেশে চলছিল অর্থাৎ উপনিবেশবাদীরা দেশকে শোষণ করবার জন্য যে সিস্টেম দেশের এডমিনিস্ট্রেশন মধ্যে চালু করে গিয়েছিল- সেই এডমিনিস্ট্রেশন, সেই সিস্টেম, সেই আইন, সেই সব কিছু পরিবর্তন করবার নামই বিপ্লব’।

‘গো অন, সিক্সটি ডিসট্রিক্টস। ষাটটি সাবডিভিশন হবে ৬০টি জেলা হবে। প্রত্যেক জেলার জন্য একজন গভর্নর থাকবে। সেখানে ডিসট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। তাঁর অধীনে এসপি থাকবেন । দলের প্রতিনিধিগণ থাকবেন, সংসদ সদস্যগণ থাকবেন, জনগণের প্রতিনিধিরা থাকবেন। কাউন্সিলে সরকারী কর্মচারীরাও থাকবেন। প্রত্যেক জেলায় অর্থাৎ বর্তমান মহকুমাসমূহে একটি প্রশাসনিক কাউন্সিল থাকবে এবং তার একজন গভর্নর থাকবেন। তিনি স্থানীয়ভাবে শাসনব্যবস্থা চালাবেন। শাসনব্যবস্থার বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। জেলা গভর্নরের কাছে কাছে যাবে আমার ওয়ার্কস প্রোগ্রামের টাকা। তার কাছে যাবে আমার খাদ্য সামগ্রী। তার কাছে যাবে আমার টেস্ট রিলিফ, লোন, বিল ও সেচ প্রকল্পের টাকা। কেন্দ্রীয় প্রশাসনের ডাইরেক্ট কন্ট্রোলে এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল ডিসট্রিক্ট এডমিনিস্ট্রেশন পরিচলানা করবে’।

এক বছরের মধ্যে থানা এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিল করতে হবে বলে সবাইকে নির্দেশ দিয়ে জাতির পিতা বলেছিলেন, ‘সেখানে বাকশালের রিপ্রেজেন্টেটিভ, কৃষকের রিপ্রেজেন্টেটিভ থাকবে, শ্রমিক থাকবে, যুবকের থাকবে, মহিলাদের থাকবে। একজন গভর্নর থাকবেন, যিনি হবেন হেড অব এডমিনিস্ট্রেশন। সেখানে মেম্বার অব পার্লামেন্ট গভর্নর হতে পারেন। সেখানে পার্লামেন্টের মেম্বার নন, এমন পলিটিক্যাল ওয়ার্কার হতে পারেন। সেখানে সরকারী কর্মচারী-যাকে বিশ্বাস করি, তিনিও হতে পারেন’।

বাকশাল এর আইডিয়াকে বঙ্গবন্ধু আমাদের নিজেদের সমাজতন্ত্র বলে বর্ণনা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘যে শোষণহীন সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার কথা আমরা বলেছি, সে অর্থনীতি আমাদের, সে ব্যবস্থা আমাদের। কোন জায়গা থেকে হায়ার করে এনে, ইম্পোর্ট করে এনে, কোন ইজম চলেনা। এদেশে-কোন দেশে চলে না। আমার মাটির সঙ্গে, আমার মানুষের সঙ্গে, আমার কালচারের সঙ্গে, আমার ব্যাকগ্রাউন্ডের সঙ্গে, আমার ইতিহাসের যুক্ত করেই আমার ইকনমিক সিস্টেম গড়তে হবে। কারণ আমার দেশে অনেক অসুবিধা আছে। কারণ আমার মাটি কি, আমার পানি কত, আমার এখানে মানুষের কালচার কি, আমার ব্যাকগ্রাউন্ড কি, তা না জানলে হয়না। ফান্ডামেন্টালি আমরা একটা শোষণহীন সমাজ গড়তে চাই, আমরা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি করতে চাই। বাট দি সিস্টেম ইজ আওয়ার্স’। উই ডু নট লাইক টু ইম্পোর্ট ইট ফ্রম এনিহোয়ার ইন দি ওয়ার্ল্ড’।

উপরে উল্লেখিত কথাগুলো জাতির জনকের নিজের মুখের কথা। অথচ আমরা জেনে-না জেনে নিজেদের স্বার্থ অনুযায়ী বাকশালের ব্যাখ্যা করে চলেছি। বিএনপি-জামাত ও তথাকথিত ‘সুশীল’ সমাজ বাকশালের অপব্যাখ্যা দিয়ে চলেছে। আর আওয়ামীলীগ এবং অন্যান্য সহযোগী সংগঠনগুলো বাকশালের প্রকৃত আদর্শ ও দর্শন নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতে তেমন কোন চেষ্টা করছেনা। অথচ জাতির পিতা দেশের গরীব মানুষের ভাগ্য ফেরাতে শেষ চেষ্টা হিসেবে এই বাকশাল কায়েম করতে চেয়েছিলেন।

শেখ মুজিবের জীবন ও রাজনীতি নিয়ে গবেষণা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক খুরশিদা বেগম।

তিনি বলছিলেন, বাকশাল গঠনের পেছনে প্রতিকূল রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দেয়ার বিষয় যেমন ছিল, একই সাথে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা টিকিয়ে রাখার প্রশ্ন ছিল বলে তিনি মনে করেন।

“যুদ্ধ-পরবর্তী অবস্থা যেটা ছিল, একেবারে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ। আমাদের কলকারখানা সব নষ্ট বা ভেঙে গেছে। রাস্তাঘাট বা অবকাঠামো নাই। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজ চলছে না। কোষাগার শূণ্য। এক কোটি মানুষ ফিরে এসেছে ভারত থেকে।”

“এই যে একটা অবস্থা, সেই সুযোগে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোও কিন্তু বসে থাকলো না। এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও ভাল ছিল না। এরকম একটা পরিস্থিতিতে দেশটাকে সামাল দিতে বঙ্গবন্ধু একপর্যায়ে এই বাকশাল গঠন করেছেন।”

বাকশাল তৈরির পটভূমি নিয়ে আলোচনায় বিশ্লেষকদের অনেকের কথায় সেই সময়কার নৈরাজ্যকর একটা পরিস্থিতির কথা উঠে আসে।

সেই পরিস্থিতির দায় কার, তা নিয়েও নানা আলোচনা রয়েছে।

লেখক ও গবেষক বদরুদ্দিন উমর বলেছেন, শেখ মুজিবের জন্য তাঁর দল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের দুর্নীতি একটা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অন্যদিকে দলের একটি অংশ বেরিয়ে যাওয়ার পর সরকার নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েছিল।”

তখন বিরোধীদের ওপর নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা নিয়েও পরিস্থিতি সামলাতে না পেরে শেখ মুজিব সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে বাকশাল গঠন করেছিলেন বলে মি. উমর উল্লেখ করেছেন।

“ঐ সময় প্রশাসন থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগ দল ইত্যাদির মধ্যে একটা ভাঙন তৈরি হয়েছিল। যে ভাঙনটা তথাকথিত আওয়ামী লীগের যে সংগঠন ছিল, সেটা দিয়ে সামাল দেয়া সম্ভব ছিল না।”

মি. উমর বলছেন, “সেখানে তাদের সহমতের দল সিপিবিসহ অন্যদের নিয়ে একটা সংগঠন করা দরকার ছিল এবং যেটা সামাল দিতে পারে। শেখ মুজিব তা মনে করেছিলেন। সেজন্যই তিনি বাকশাল করেছিলেন।”

আওয়ামী লীগের একটা অংশ বেরিয়ে গিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে জাসদ নামের দল গঠন করেছিল ১৯৭২ সালের অক্টোবরে।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সর্বহারা বা চরমপন্থী কিছু বামদলের সশস্ত্র তৎপরতাও চলছিল।

আওয়ামী লীগের নেতারা সে সময়ের নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্য জাসদ এবং চরমপন্থী দলগুলোর ওপরই দায় চাপিয়ে থাকেন।

আওয়ামী লীগ নেতা নূহ আলম লেনিন বাকশাল প্রতিষ্ঠার সময় আওয়ামী লীগের মিত্র কমিউনিস্ট পার্টির রাজনীতিতে ছিলেন।

মি. লেনিন বলছেন, দুর্নীতি, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির চরম অবনতি এবং ‘৭৪ সালের দুর্ভিক্ষ, সব মিলিয়ে ভয়াবহ সংকটের মুখে বাধ্য হয়ে বাকশাল গঠন করা হয়েছিল।

“একদিকে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তর থেকে বেরিয়ে একটা অংশ জাসদ নামের দল করার পাশাপাশি গণবাহিনীও গঠন করলো তাদের সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে তথাকথিত বিপ্লবের চিন্তা থেকে।”

“অন্যদিকে আগে থেকেই অতিবাম বা চরমপন্থীরা যেমন সর্বহারা পার্টির মতো, তারা বিভিন্ন অঞ্চলে শ্রেনিশত্রু খতমের নামে নৈরাজ্য সৃষ্টি করলো। বিভিন্ন জায়গায় হত্যা, সন্ত্রাস, বাড়ি-ঘর লুট, দেশের সম্পদ লুট চললো।”

সেই পটভূমি তুলে ধরতে গিয়ে মি. লেনিন আরও বলেন, “তখনকার জাসদ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনে আক্রমণ চালায়। তখন সরকার নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার মতো উপক্রম হয়। এছাড়া ‘৭৪ সালে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তখনই বঙ্গবন্ধু ভাবতে শুরু করেন যে, রাষ্ট্রীয়ভাবে একটা দল গঠন করে রাজনৈতিক ও সামাজিক সব শক্তিকে নিয়ে দেশ পুনর্গঠনের কাজটি করবেন।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের পর প্রত্যাশা অনুযায়ী গণতন্ত্রের সুফল মানুষের কাছে পৌঁছানো যায়নি। সেকারণে রাজনীতি এবং অর্থনীতি সব দিক থেকেই বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক দিলারা চৌধুরী বলছিলেন, শেখ মুজিবের ক্ষমতা অল্প সময়ের মধ্যেই চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছিল।

“একটা রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। এই যুদ্ধের সময় জনগণের মাঝে আশা আকাঙ্খা যেমন বেড়েছিল, সে রকম জনগণ এটাও বুঝেছিল যে, আবার দরকার হলে আমরা অস্ত্র ধরে সরকারকে চ্যালেঞ্জ করতে পারবো। যেটা বামপন্থীরা করেছিল। তাঁর রেজিমকে চ্যালেঞ্জ করেছিল।”

“উনিতো গণতন্ত্র পুরোপুরি প্রতিষ্ঠা করতে পারেন নাই। তার আগেইতো উনার রেজিমকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। এই বামরা এবং বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র, তারা সেটা করেছিল। সেজন্য এটা করা হয়েছিল। এটা আমার বিশ্লেষণ।”

উনিশশো চুয়াত্তর সালের ১৭ই মার্চ ঢাকার রমনা এলাকায় তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মনসুর আলীর বাসভবন ঘেরাও করেছিল জাসদ। তখন সেখানে গোলাগুলি হয়েছিল এবং হতাহত হয়েছিল অনেক মানুষ।

এর আগে দু’বছর ধরে অনেক রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে হত্যা, খাদ্য ও পাটের গুদামে আগুন, থানা লুটের মতো নাশকতা চলছিল দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।

আওয়ামী লীগের একজন বর্ষীয়ান নেতা ডা. এস এ মালেক বলছিলেন, সেই সময়ের পরিস্থিতি বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সামাল দেয়া সম্ভব ছিল না।

“সেদিন ‌৭২-এর সংবিধান প্রণয়ন করে সংসদের নির্বাচন দিয়ে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হলো। কিন্তু আমরা কি দেখলাম? একদিকে সংসদীয় অবাধ গণতন্ত্র অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়ি আক্রমণ। পাঁচজন সাংসদকে মেরে ফেলে দেয়া হলো। রেল লাইন তুলে ফেলা হলো। এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি সেখানে তৎপর হলো।”

তিনি আরও বলেছেন, “এই পরিস্থিতিতে আমার মতে, বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সংসদীয় গণতন্ত্র দিয়ে দেশ শাসন করা সম্ভব ছিল না। সেজন্য তিনি বাকশালের মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যের কথা বললেন। তিনি সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে উন্নয়ন কর্মসূচি নিয়ে এগুতে চেয়েছিলেন।”

উনিশশো পচাত্তর সালের ৭ই জুন যখন বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হয়, তখন বিলুপ্ত করা হয়েছিল আওয়ামী লীগসহ সব রাজনৈতিক দল।

রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে চারটি পত্রিকা রেখে বাকি সব পত্রিকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল।

বদরুদ্দিন উমর বলেছেন, বাকশাল ছিল একনায়কতন্ত্র, সেজন্য মানুষ তা গ্রহণ করেনি।

“বাকশাল গঠনের পরে দেশের ওপর ফ্যাসিস্ট জুলুম আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। সব দলকে বন্ধ করে দিয়ে, নিষিদ্ধ করে দিয়ে, সব খবরের কাগজ নিষিদ্ধ করে দিয়ে লোকজনকে ধরপাকড় করে ব্যাপকভাবে জুলুম করেছিলেন।”

মি. উমর মনে করেন, কৃষক-শ্রমিকের সাথে বাকশালের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

“এটা কি সহজ জিনিস নাকি সমস্ত সংবাদপত্র বন্ধ করে দিলাম। হাজার হাজার লোককে জেলে দিলাম। এটা কি খেলনা জিনিস? সেজন্যই লোকে মনে রাখে এবং সমালোচনা করে।”

তবে শেখ মুজিব বাকশালকে দ্বিতীয় বিপ্লব হিসাবে ঘোষণা করেছিলেন।

ডা. এস এ মালেকের বক্তব্য হচ্ছে, গ্রামে গ্রামে বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠা করে মালিক তার জমি দেবেন এবং রাষ্ট্রের অর্থে ভূমিহীন কৃষক সেই জমিতে আবাদ করবেন। সেই উৎপাদিত ফসল তিন ভাগে ভাগ হবে। আর শিল্প কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকের প্রতিনিধি রেখে তাদের অধিকার নিশ্চিত করা। এই দু’টি কর্মসূচিই ছিল বাকশালের অন্যতম প্রধান বিষয়।

সমালোচনাঃ

বাকশাল: গণমুখী প্রকল্প না একনায়কতান্ত্রিক রূপকল্প?

বাংলাদেশের ইতিহাসে অন্যতম বিতর্কিত রাজনৈতিক রূপকল্পটি হচ্ছে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশাল গঠন। ১৯৭৫ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ, সিপিবি, ন্যাপ (মোজাফফর) এবং জাতীয় লীগ তাদের নিজস্ব দল বিলুপ্ত করে সোভিয়েত ধাঁচে বাকশাল গঠন করে।

সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির মত বাকশালেও সরকারী কর্মকর্তা এবং ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দকে যোগদান করতে বাধ্য করা হয় এবং সকল রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। এর আগে ২৫ জানুয়ারী সংসদে দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে কাজে লাগিয়ে বাকশাল গঠনের লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনে।

চতুর্থ সংশোধনীর মূল আবেদনটা ছিল উপনিবেশিকতার সূত্রে প্রাপ্ত পাশ্চাত্যের উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক ধারার বিপরীতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরোপীয় দেশগুলির আদলে একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং এর মাধ্যমে অর্থনীতির সমস্ত চালিকা শক্তি রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়া। একে মনে করা হত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা যেখানে রাষ্ট্র পরিচালিত হবে এক ব্যক্তির হুকুমে এবং সমস্ত কল কারখানা, ব্যবসা বাণিজ্য পরিচালনা করবেন আমলারা।

এ ধরণের ব্যবস্থায় প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া তাত্ত্বিকভাবে থাকবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আর বাস্তবে থাকবে ক্ষ্মতাসীন দলটির হাতে। মিডিয়াতে ক্ষমতাসীন দলের চিন্তা চেতনার বাইরে কোন মত প্রকাশ করা যাবে না এবং দল প্রধান ও দলের কোন কাজের সমালোচনাও করা যাবে না।

ওসময় সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনসহ যেকোন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এমনভাবে সংবাদ পরিবেশন করত যাতে তাদের নিজ দেশটিকেই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম দেশ মনে হয়। এ সমস্ত দেশে কোন বিরোধী দল, ছাত্র সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন ছিল না। সিভিল সোসাইটি ছিল রাষ্ট্রের প্রতি সম্পূর্ণ অনুগত। লেখনী বা অন্য কোন মাধ্যমে ওসময় সরকার, রাষ্ট্র বা কমিউনিস্ট পার্টির কোন অসঙ্গতি যারা তুলে ধরতে চেয়েছেন তাঁদের সবাইকে সাম্রাজ্যবাদের দালাল বা পুঁজিবাদের প্রতিভূ আখ্যায়িত করে জেল, ফাঁসি বা নির্বাসন এসব দণ্ড দেওয়া হয়েছে।

খুব অদ্ভুত ব্যাপার হল আওয়ামী লীগের মত পুঁজিবাদী অর্থনীতি এবং গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠন করে কেউ যাতে বঙ্গবন্ধু এবং আওয়ামী লীগকে সমালোচনা করতে না পারে তার জন্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মতই ১৯৭৫ সালের জুন মাসে চারটি সংবাদপত্র ছাড়া সব সংবাদপত্র নিষিদ্ধ করে দেয়। এ নিষিদ্ধের খড়গ ‘সোভিয়েত ঘেঁষা’ হিসাবে পরিচিত সংবাদপত্র ‘ দৈনিক সংবাদ’ এর উপরেও পরে। সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে সমস্ত মিডিয়া যেমন সার্বক্ষণিক নেতা এবং দলের বন্দনা করত, তেমনি বাকশাল নেতৃবৃন্দও বাংলাদেশে এ ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চাচ্ছিলেন বলে আপাতঃ দৃষ্টিতে মনে হয়।

এ সমস্ত দেশে একনায়কতান্ত্রিক বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা যেটাকে বলেন সর্বাত্মকবাদী শাসন, এ ধরণের শাসন বলবৎ থাকলেও সেসমস্ত দেশের রাষ্ট্র, সরকার, পার্টি এবং মিডিয়া এ ধরণের ব্যবস্থাকে জনগণের গণতন্ত্র, পুঁজিবাদের চেয়ে উন্নত গণতন্ত্র বা মহত্তম গণতন্ত্র এ সমস্ত নামে অভিহিত করত। বাংলাদেশেও যারা বাকশাল ব্যবস্থাকে সমর্থন করতেন তাঁরা মনে করতেন বাংলাদেশেও এভাবে একনায়কতান্ত্রিক, একদলীয় শাসনের মধ্য দিয়েই ক্রমান্বয়ে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উত্তরণ ঘটবে এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক সামতা কায়েমের মধ্য দিয়ে গণমানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত হবে। অর্থাৎ, সোনার পাথর বাটি ধরনের যুক্তিতে বিশ্বাস করতেন।

একনায়কতান্ত্রিক-একদলীয় শাসনের মধ্য দিয়েই সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর লক্ষ্য নিয়ে চতুর্থ সংশোধনীর মধ্য দিয়ে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়। এতে সংসদীয় ব্যবস্থা বিলোপ করে প্রেসিডেন্টকে সব ক্ষমতা দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার কায়েম করা হয়। এর মাধ্যমেই সমাজতান্ত্রিক দেশগুলির মত বঙ্গবন্ধুর হাতে সব ক্ষমতা দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করা হয়।

রাষ্ট্রপতির ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করবার জন্য একদিকে সংসদের ক্ষমতা খর্ব করা হয়; অন্যদিকে, বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে ক্ষুন্ন করে এ বিভাগকে অনেকটাই নির্বাহী বিভাগ বা রাষ্ট্রপতির অধীনে নিয়ে আসা হয়। পাশাপাশি, সুপ্রীম কোর্ট যাতে মানুষের মৌলিক মানবাধিকার নিশ্চিত করতে না পারে সে ব্যবস্থাও নেয়া হয়।

চতুর্থ সংশোধনীর আরেকটি বড় বৈশিস্ট্য ছিল বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে একদলীয় শাসন কায়েম।বস্তুত, এর মাধ্যমেই বাকশাল ব্যতীত সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ হয় এবং দেশ সমাজতন্ত্রের পথে অগ্রসর হচ্ছে বলে মনে করা হয়।

তবে, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সাথে বাংলাদেশের পার্থক্য ছিল যে ওসমস্ত দেশে একদলীয় শাসন কায়েম হয়েছিল বিপ্লবের নামে জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল অথবা সেনাবাহিনী বা বহিঃশক্তির (মূলত সোভিয়েত ইউনিয়ন) সহয়তায় ক্ষমতা দখলের মাধ্যমে। কিন্তু, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ভাবে নির্বাচিত সংসদ সদস্যরাই সংসদে ভোট দিয়ে নিজেদের গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচিত হবার পথ রুদ্ধ করে দিয়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটান, যা আধুনিক সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরল ঘটনা।

বাকশাল সম্ভবত বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে অজনপ্রিয় রাজনৈতিক রূপকল্প। এ অজনপ্রিয়তার ফলেই মুসলিম জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী সেনাবাহিনীর কিছু জুনিয়র অফিসার কর্তৃক সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নির্মমভাবে নিহত হবার পর যখন বাকশালে বিলুপ্ত হওয়া আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দলকে পুনুরুজ্জীবনের সিদ্ধান্ত নেন তখন বাকশালকে না এনে আওয়ামী লীগকে আবার রাজনীতিতে ফিরিয়ে আনেন। মুজিব উত্তর আওয়ামী নেতৃবৃন্দ এ রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে পেরেছিলেন যে বাকশাল নাম দিয়ে দল পুনুরুজ্জীবন ঘটালে বাংলাদেশের রাজনীতিতে টিকে থাকা সম্ভব নাও হতে পারে।

আজীবন গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামী বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগকে বিলুপ্ত করে কেন বাকশাল গঠন করে একলদলীয় শাসন কায়েম করলেন এ বিষয়টি নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণার অভাবে ইতিহাসের এ বাঁকটি এখনও অনেকটাই অন্ধকারে রয়ে গেছে। ১৯৭৪ সালের দুর্ভিক্ষের চেয়েও বাকশাল গঠন ১৯৭০-৭১ সালের প্রবল জনপ্রিয় দল আওয়ামী লীগ এবং বঙ্গবন্ধুকে তৎকালীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে দ্রুত অজনপ্রিয় করে ফেলে।

প্রখ্যাত ঐতিহাসিক সালাহউদ্দিন আহমদ তাঁর Bangladesh: Past and Present (2004: p. 213) গ্রন্থে বাকশালের ধারণা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের ধারণার সম্পূর্ন পরিপন্থী হওয়ায় একে ‘বাংলাদেশের রাজনৈতিক মৃত্যু’ বলে অভিহিত করেছেন কেননা স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো নির্মাণের প্রত্যয়কে সামনে রেখে।

‘গণতন্ত্রের মানসপুত্র’ হিসাবে খ্যাত হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির ‘রাজনৈতিক শিষ্য’ বঙ্গবন্ধু, যিনি সব সময়ই বাম ধারার সমাজতান্ত্রিক, একনায়কতান্ত্রিক শাসনের বিরুদ্ধে ছিলেন- তিনি কেন স্বাধীন বাংলাদেশে যে রাজনীতির সারা জীবন বিরোধিতা করে এসেছেন, সেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শকেই বাকশালের মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে চাইলেন?

কেউ কেউ এর জন্য বহিস্থ শক্তি অর্থাৎ তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের চাপকে দায়ী করতে চান। সেসময়ের দ্বিমেরু বিশ্বে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জনকারী বাংলাদেশের পক্ষে আর কোনও বিকল্প ছিল না বলে তাঁরা মনে করেন।

কিন্তু, এখন পর্যন্ত কোন দালিলিক প্রমাণ পাওয়া যায় নাই যে সোভিয়েত সরকার বঙ্গবন্ধুকে একদলীয় শাসন কায়েমের জন্য চাপ দিচ্ছিল। আর তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেয়া যায় যে বঙ্গবন্ধুর উপরে সোভিয়েত চাপ ছিল তাহলে স্বভাবতই এ প্রশ্ন উঠতে পারে যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন, পাকিস্তান এবং সৌদি আরবের চাপ উপেক্ষা করতে পেরেছেন, সেই তিনি কেন সোভিয়েত চাপ উপেক্ষা করতে পারবেন না! বিশেষত যখন ভারত এ একদলীয় ব্যবস্থাকে ভাল চোখে দেখেনি।

কেউ কেউ এর জন্য আবার তৎকালীন ‘মস্কোপন্থী’ ক্ষুদ্র রাজনৈতিক দল সিপিবি এবং ন্যাপ (মো) এর উপর দায় চাপাতে চান। তাদের ভাষ্য হল সিপিবি এবং ন্যাপের (মো) ‘চাপ’ এবং পরামর্শেই বাকশালের মত এ ধরনের হটকারি পদক্ষেপ বঙ্গবন্ধু নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের মত বিশাল জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল এবং বঙ্গবন্ধুর মত প্রাজ্ঞ নেতৃত্ব মণি সিংহ এবং অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদের কথায় এত বড় সিদ্ধান্ত নিবেন তা একমাত্র অর্বাচীন লোকের পক্ষেই বিশ্বাস করা সম্ভব।

তাহলে, কী এমন ঘটল যার জন্য একজন আজীবন গণতন্ত্রী বঙ্গবন্ধু, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধে স্থির না থেকে আকৃষ্ট হলেন তৎকালীন সময়ের তাঁর সম্পূর্ণ বিপরীত চিন্তাধারার নেতৃত্ব এবং আদর্শের প্রতি। কেনইবা, কিম ইল সুং, মাও জে দং, হো চি মিন, ফিদেল কাস্ত্রো, মার্শাল টিটো, আনোয়ার হোজ্জা বা মুয়াম্মার গাদ্দাফির মত নেতৃত্বকে বাংলাদেশের উন্নয়ন উপযোগী মনে করলেন? কেনইবা তিনি পাশ্চাত্য জাত গণতান্ত্রিক মডেলকে বাংলাদেশর উন্নয়ন এবং বিকাশের জন্য প্রতিবন্ধক মনে করলেন? এ বিষয়গুলো বুঝবার জন্য চোখ ফেরান যাক তৎকালীন আন্তর্জাতিক এবং জাতীয় রাজনীতির দিকে।

শীতল যুদ্ধকালীন সত্তর দশকের বিশ্ব পরিস্থিতি বর্তমান সময়ের চেয়ে ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ক্রমাগত সোভিয়েত এবং চীনের প্রোপাগান্ডার জেরে সেসময় অনেকেই এমনকি অনেক ডানপন্থীও বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন যে খুব শীঘ্রই হয়ত সারা দুনিয়াতে কমিউনিজম কায়েম হয়ে যাবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যকে পেয়ে বসেছিল কমিউনিজমের আতঙ্কে।

সেসময়টায় একের পর এক দেশ উপনিবেশিকে শাসন থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধীন হচ্ছে। পাশ্চাত্যের দেশ কর্তৃক এ সমস্ত দেশ যেহেতু উপনিবেশিকতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়েছিল, তাই পশ্চিমের গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদের চেয়ে সমাজতন্ত্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি কিছু ব্যতিক্রম বাদে এ সমস্ত দেশের নেতৃবৃন্দ আকৃষ্ট হন। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোতে ওই সময় সোভিয়েত ইউনিয়নকে অনুসরণ করে একনায়কতান্ত্রিক,একদলীয় শাসন এবং আমলা দ্বারা অর্থনীতি পরিচালনা অর্থাৎ রাষ্ট্রয়াত্ত অর্থনীতির জোয়ার এসেছিল। অপরদিকে, সোভিয়েত ঘেঁষা একদলীয় শাসন ঠেকাবার জন্য মরিয়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সিআইয়ের সহায়তায় সামরিক অভ্যুথান সংগঠিত করছিল।

উন্নয়নশীল বিশ্বে এক দলীয় শাসনকে ‘জায়েজ’ করবার জন্য সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির তাত্ত্বিকরা ওই সময় এক নয়া তত্ব হাজির করে যা বামধারার বিভিন্ন দেশের একনায়ক এবং বাংলাদেশের সিপিবি সাথে সাথে লুফে নেয়। তাঁরা সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশগুলোর একদলীয় শাসন কায়েমকে জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং এ ধরনের শাসনকে জাতীয় গণতন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে। সোভিয়েত তাত্ত্বিকদের মতে এ ধরণের একদলীয় শাসন হচ্ছে জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে গণতান্ত্রিক শাসন এবং সমাজতন্ত্রে পৌঁছানোর প্রথম ধাপ। এ একদলীয় শাসনের মধ্য দিয়েই এ সমস্ত উন্নয়নশীল দেশ সোভিয়েত সহয়তায় শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়ে এক সময় সমাজতান্ত্রিক দেশে রূপান্তরিত হবে। সেসময় অনেকেই মনে করতেন সোভিয়েত ঘেঁষা একদলীয় শাসন হচ্ছে দ্রুত শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হবার একমাত্র পথ।

সোভিয়েত তাত্ত্বিকদের অনুসরণ করে বাকশালকেও মনে করা হত জাতীয় ঐক্যমতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্র। বাকশাল সমর্থক অনেকেই মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন এটি নতুন ধরনের তৃতীয় বিশ্বের উপযোগী গণতান্ত্রিক শাসন। এরা কোন অবস্থাতেই একে একদলীয় বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা মনে করতেন না, যেমনটা কিনা সিপিবিসহ সারা দুনিয়ার কমিউনিস্টরা একদলীয় সোভিয়েত ব্যবস্থাকে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক শাসন বলে মনে করতেন।

সোভিয়েত ধাঁচে বাকশাল করা হলেও এটি যে সোভিয়েত অনুকরণে করা নয় তা বুঝাবার জন্য বাকশাল সমর্থন যারা করতেন তাঁরা এক নতুন প্রত্যয়ের জন্ম দিলেন কমিউনিস্টদের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ প্রত্যয়কে অনুসরণ করে। খন্দকার মোহাম্মদ ইলিয়াস ১৯৭২ সালে লিখলেন ‘মুজিববাদ’ নামে এক গ্রন্থ। এ গ্রন্থ অনুসরণ করে বলা হতে লাগল, বঙ্গবন্ধুর বাকশাল সোভিয়েত বা গণচীনের অনুকরণে সমাজতন্ত্র নয়, বরং এটি তৃতীয় বিশ্বের উপযোগী ভিন্ন ধরণের সমাজতন্ত্র। এ ধারার অনুসারীরা শ্লোগান দিলেন, ‘বিশ্বে এল নতুন বাদ, মুজিব্বাদ, মুজিব্বাদ’।

মুজিববাদকে নতুন মতবাদ বলা হলেও ষাট এবং সত্তরের দশকে অনেকেই যারা সোভিয়েত ধাঁচের একদলীয় শাসন কায়েম করেছিলেন তাঁদের অনেকেই সে বিষয়টিকে এড়াবার জন্য এ ধরনের একনায়কতন্ত্রকে তাঁদের দেশজ উপযোগী নতুন ধরণের সমাজতন্ত্র বলে অভিহিত করতে লাগলেন।ফলে,কিউবাতে আমরা দেখি কাস্ত্রোবাদ,আলবেনিয়াতে হোজ্জাবাদ, যুগোস্লাভিয়াতে টিটোবাদ, তানজানিয়াতে জুলিয়াস নায়ারেরের উজাম্মা (সমাজতন্ত্র), ইরাক এবং সিরিয়াতে বাথ (পুনর্জাগরণ) সমাজতন্ত্র, গণচীনে মাও সে তুঙ্গের চিন্তাধারা, উত্তর কোরিয়াতে জুচে (আত্মনির্ভরশীল) ধারণা ইত্যাদি। নামের ভিন্নতা ব্যতিরেকে সবই ছিল মূলত একই ধাঁচের শাসন; অর্থাৎ, একনায়কতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা এবং রাষ্ট্র, তথা আমলা পরিচালিত অর্থনীতি।

আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ডান (সামরিক শাসন) এবং বাম (সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা) একদলীয় শাসনের প্রবল দাপটের যুগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এর প্রভাব ছিল প্রবল। স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করায় সকল ‘ইসলামপন্থী’ দল তখন নিষিদ্ধ। বাম দলগুলোর তখন রাজনীতিতে প্রবল প্রতাপ। দেশের প্রধান বিরোধী দল ন্যাপ (ভাসানী) ছিল গণচীন তথা মাওয়ের নীতির একনিষ্ঠ সমর্থক অর্থাৎ একনায়কতান্ত্রিক শাসন এবং ব্যক্তি পূজার সমর্থক।

জাসদ গণবাহিনী গঠন করে মুজিব সরকারকে হটিয়ে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র তথা একদলীয় শাসন কায়েমের জন্য ছিল মরিয়া। সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি, মোহাম্মদ তোয়াহার সাম্যবাদী দল মাওকে অনুসরণ করে ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও’ করে বঙ্গবন্ধু সরকারকে হটিয়ে চীনের আদলে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করছিল। এমনকি সবচেয়ে ‘নরম’ বামপন্থী হিসাবে পরিচিত সিপিবি এবং ন্যাপ (মো) যে একদলীয় শাসনের প্রবল সমর্থক ছিল সেটা তাদের বাকশালে যোগদান থেকেই বোঝা যায়।

একদিকে, এসমস্ত বাম দলগুলির প্রকাশ্য, অপ্রাকাশ্য তৎপরতায় সরকার ছিল দিশাহারা; অপরদিকে কিছু ব্যতিক্রম বাদে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা মেতে ওঠে লুটপাট, চোরাচালান, দুর্নীতি, সন্ত্রাসের মহা উৎসবে। একটি যুদ্ধ বিধস্ত দেশে দেশবাসী যখন আশা করছিল আওয়ামী নেতাকর্মীরা দেশ গঠনে নেতৃত্ব দেবে, সেখানে তাদের এ ভূমিকা জনগণকে প্রচণ্ড হতাশ এবং দিশাহারা করে তোলে।

যুদ্ধবিধস্ত দেশে আইন শৃংখলা রক্ষায় তাজউদ্দীন আহমেদের পরামর্শে বঙ্গবন্ধু ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানকে ডাইরেক্টর জেনারেল করে ১৯৭২ সালে গঠন করেন প্যারা মিলিটারি ফোর্স, জাতীয় রক্ষীবাহিনী। প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকেই বিতর্কের জন্ম দেয় এ বাহিনী।

গবেষক মইদুল হাসান (মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর : কথোপকথন; প্রথমা প্রকাশন ২০১১) সহ অনেকেই বলতে চেয়েছেন এ বাহিনী গঠন এবং ট্রেনিং দেবার ক্ষেত্রে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা র’ এর মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান এর বড় ভূমিকা রয়েছে। উবান ১৯৭১ সালে দেরাদুনে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স যা জনসাধারণের মাঝে মুজিব বাহিনী নামে পরিচিত ছিল তার ট্রেনিংয়ের সাথেও যুক্ত ছিলেন।

মুক্তিবাহিনীর সদস্য ছাড়াও রক্ষীবাহিনীর একটা বড় অংশ রিক্রুট হয়েছিল এ মুজিব বাহিনী থেকে। খয়েরী রঙের ইউনিফর্ম পরা এ বাহিনী বিরোধী নেতা কর্মীদের বিশেষত জাসদ কর্মীদের হত্যা, গুমে জড়িয়ে পড়ে। এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও গুপ্ত বাম সংগঠন সমূহ দ্বারা ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে থাকেন।

ইতিহাসে চোখ ফেরালে দেখা যায়, যেসমস্ত দেশে ডান বা বাম ঘরানার একদলীয় বা একনায়কতান্ত্রিক শাসন ছিল সেসমস্ত দেশেই এ ধরণের এলিট প্যারা-মিলিটারি ফোর্স গঠন করা হয়েছিল বিরোধী মতকে দমন করবার জন্য। এ থেকে একটি প্রশ্ন উঠতেই পারে তা হলো ১৯৭২ সাল থেকেই কি বঙ্গবন্ধু একদলীয় শাসন কায়েম করে দেশকে আস্তে আস্তে সমাজতন্ত্রের পথে নিয়ে যেতে চাচ্ছিলেন? মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা, বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধী অবস্থানই কি উদারনৈতিক গণতন্ত্র এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতি সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর মোহভঙ্গ ঘটেছিল?

এর পাশাপাশি, ১৯৭৪ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের ফলে বঙ্গবন্ধুর মাঝে কি এ ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গিয়েছিল যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির পথ ধরে পাশ্চাত্যের উপর নির্ভর করে বাংলাদেশকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়? খাদ্য ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা, চোরাচালানি ইত্যাদি মানব সৃষ্ট আরো নানা কারণের পাশাপাশি প্রাকৃতিক কারণ থাকলেও কিউবাতে পাট রপ্তানির সিদ্ধান্তের ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হঠাৎ করে ২২ লক্ষ টন খাদ্য সাহায্য স্থগিত করে দেয়। যার ফলে যুদ্ধ বিধস্ত দেশে জাতিকে এক অভাবনীয় দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি হতে হয়।

কিন্তু এর চেয়েও জাতিকে যে বিষয়টা স্তম্ভিত করে তোলে তাহল সারা দেশ থেকে দুর্ভিক্ষ পীড়িত যে সমস্ত মানুষ বাঁচার আশায় ঢাকা এসেছিল তাদেরকে শহর থেকে বের করে দেবার জন্য রক্ষী বাহিনীকে ‘ক্লিন ঢাকা’ অপারেশন পরিচালনার দায়িত্ব দেয়া। এ অপারেশনে রক্ষী বাহিনী দুই লক্ষ দুর্ভিক্ষ পীড়িত, দরিদ্র মানুষকে ঢাকা থেকে বের করে দেয়। এ দরিদ্র মানুষের উপর ‘বীরত্ব’ দেখাতে পারলেও বঙ্গবন্ধু নিহত হবার পর ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামানসহ এ রক্ষী বাহিনীর ১৬ হাজার সদস্যের একজনও এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে বীরত্ব দেখাতে পারে নাই।

বস্তুত, এ রক্ষী বাহিনী তৈরি করেও আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি ঘটাতে না পারা, পুঁজিবাদী পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে না পারবার ব্যর্থতাজনিত হতাশা, পাশ্চাত্যের সহযোগিতা না পাওয়া, দলীয় নেতাকর্মীদের সীমাহীন দুর্নীতি, বিরোধীদলসহ নানা মহল থেকে বঙ্গবন্ধুর ক্রমাগত সমালোচনার মুখে ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর মুজিব জরুরী অবস্থা জারী করেন। ১৯৭৫ সালের ২৬শে মার্চ তিনি কিছু সংস্কার প্রস্তাব করে শেখ মনি উদ্ভাবিত দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন, যা ছিল বাকশাল গঠনের মূল ভিত্তি।

হুবহু একরকম না হলেও সারবস্তুগতভাবে বঙ্গবন্ধু এ দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন মাও সে তুঙ্গের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আলোকে। ১৯৪৯ সালে বিপ্লবের পর সমাজের সর্বস্তরে মাওয়ের চিন্তাধারা প্রতিষ্ঠা করবার জন্য ১৯৬৬ সালে মাও এ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন। এ বিপ্লবের মর্মবাণী ছিল মাও বিরোধী সমস্ত চিন্তাধারাকে সমাজ থেকে উচ্ছেদ করা। দ্বিতীয় বিপ্লবেরও মূল লক্ষ্য ছিল সমাজ হতে সব ধরনের দুর্নীতি উচ্ছেদ করে আইন শৃঙ্খলার উন্নয়নের পাশাপাশি সমাজ এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তরে বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারাকে প্রতিষ্ঠা করা। বস্তুত, এ লক্ষ্যকে সামনে রেখেই সব ধরণের বিরোধী দল,মত এবং স্বাধীন মিডিয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, যাতে বাকশালের আদর্শের বাইরে অন্য কোন আদর্শ বা চিন্তা সমাজে বিস্তার লাভ করতে না পারে।

যে লক্ষ্য এবং স্বপ্ন নিয়ে বঙ্গবন্ধু বাকশাল গঠন করেছিলেন তা বাস্তবায়নের সুযোগ তিনি পাননি। সমাজতান্ত্রিক এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার বিরোধী, পাকিস্তানের মত পুঁজিবাদের সাথে ইসলামের সমন্বয় করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ, সৌদি আরবের সাথে উন্নত সম্পর্কে বিশ্বাসী একদল জুনিয়র সেনা অফিসারের হাতে সমাজতান্ত্রিক পথে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে চাবার জন্য বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হতে হয়।

নানা প্রতিক্রিয়াশীল তৎপরতায় দিশেহারা বঙ্গবন্ধু তৎকালীন বিশ্ব প্রেক্ষাপটে আরো অনেকের মতই দেশের উন্নয়নে সমাজতন্ত্রের পথের কথাই ভেবেছিলেন। ইতিহাসে নির্মম ট্রাজেডি হল যে সমস্ত দেশকে তিনি আদর্শ মনে করেছিলেন তার কোনটাতেই সমাজতন্ত্রের পথের নিরীক্ষার সফলতা পায় নাই। একমাত্র উত্তর কোরিয়া ছাড়া যারা এখনো সমাজতন্ত্রের কথা বলে টিকে আছে, তাদেরকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির অনেক কিছু ধারণ করেই টিকে থাকতে হচ্ছে।

বঙ্গবন্ধু বাকশালের নিরীক্ষা চালাবার জন্য যে কয়মাস সময় পেয়েছিলেন, সে কয়মাস বাকশালের ভবিষৎ এর খুব একটা উজ্জ্বল চিত্র দেখা যায়নি। এ সময়টা বিরোধী দলমত কঠিনভাবে নিয়ন্ত্রিত থাকায় অর্থনীতি পরিচলানার দায়িত্বে থাকা আমলারা এবং কিছু সংখ্যক আওয়ামী নেতা কর্মীরা জাতীয় সম্পদের ব্যাপক লুটপাটের সুযোগ পায়। বস্তুত, এ লুটেরা গোষ্ঠীর হাত ধরেই পরবর্তীতে বাংলাদেশে পুঁজিবাদী অর্থনীতির উন্মেষ এবং বিকাশ ঘটে। পাশ্চাত্যের উন্নত দেশের পুঁজিবাদী অর্থনীতির বিকাশ ঘটেছিল উপনিবেশিক শোষণের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ সুযোগ না থাকবার ফলে এর প্রাথমিক উন্মেষ ঘটেছিল বাকশাল আমলে লুটপাটের মাধ্যমে জন্ম নেয়া ধনিক শ্রেণীর মাধ্যমে।

তারুণ্যে বঙ্গবন্ধু আকৃষ্ট হয়েছিল মুসলিম লীগের রাজনীতির প্রতি, যৌবনে ধর্ম- নিরপেক্ষ আর পরিণত বয়সে সমাজতন্ত্রের প্রতি, যার ফলশ্রুতি হল বাকশাল এবং একদলীয় শাসন।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পরে অনুষ্ঠিত পার্টি কংগ্রেসে সিপিবি বাকশালে যোগদানের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল বলে মূল্যায়ন করেছে। কিন্তু বাকশাল গঠন বা একদলীয় শাসন ভুল ছিল কিনা- এ সম্পর্কে তারা কখনো স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। আওয়ামী নেতৃত্বে একদলীয় শাসন হয়ত তাদের দৃষ্টিতে ভুল ছিল। কেননা এটা বাম দলের নেতৃত্বে হয় নাই। কিন্তু , কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে একদলীয় শাসন তাদের কাছে ভুল কিছু নয়, যেহেতু এখনো তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, কিউবা বা উত্তর কোরিয়ার এক দলীয় শাসনকে ভুল মনে করে না।

অপরদিকে, আওয়ামী লীগ পরিণত বয়সের বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথ অনুসরণ না করলেও ব্যক্তি এবং পরিবার বন্দনার রাজনীতির নিগড় থেকে এখনো বেরিয়ে আসতে না পারবার ফলে বঙ্গবন্ধুর বাকশাল গঠনের সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কোন মূল্যায়ন করতে পারেনি। ব্যক্তি এবং পরিবার বন্দনার রাজনীতি থেকে আওয়ামী লীগ যতদিন বেরিয়ে আসতে না পারবে বঙ্গবন্ধুর মতো মহান নেতার শেষ জীবনের রাজনীতি সম্পর্কে ততদিন পুরোপুরি ধারণা পাওয়া যাবে না।

সূত্র

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম অধ্যয়ন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বিবিসি বাংলা।

https://opinion.bdnews24.com

বাকশাল: গণমুখী প্রকল্প না।

0 Shares:
Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

You May Also Like

স্যানিটারি ন্যাপকিন ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা

প্রতিটি নারীর জীবনে মাসিক একটি অতি স্বাভাবিক শারীরবৃত্তীয় ব্যাপার হলেও বাংলাদেশের সামাজিক প্রেক্ষাপটে এ বিষয়টি এখনো যেন অত্যন্ত…

The Matrix Trilogy — ফুল কনসেপ্ট এক্সপ্লেইন্ড | সায়েন্টিফিক থিওরি | ইন্ডিং এক্সপ্লেইন্ড উইথ প্যারাডক্স | ফ্যাক্টস

কেউ চাইলে নির্দ্বিধায় আমার লিখা এই আর্টিকেল টি শেয়ার করতে পারেন। আমার কোনো আপত্তি নেই। সাই-ফাই মুভিপ্রেমিদের মুখে…